binodonerpadmaful
ঢাকা সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর, ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১
স্মরণ

শুনেছি সেদিন তুমি, এঁকেছিলে জন্মভূমি


বিনোদনের পদ্মফুল | অ্যাডভোকেট মীর আব্দুল হালিম নভেম্বর ১৫, ২০২৪, ০৪:৩৮ পিএম শুনেছি সেদিন তুমি, এঁকেছিলে জন্মভূমি

১৯ নভেম্বর ২০২৪ ইং তারিখে বীর মুক্তিযোদ্ধা মরহুম এটিএম ওয়ালী আশরাফ ভাইয়ের ৩০তম মৃত্যুবার্ষিকীতে এক ভক্তের নিবেদন। প্রতিবছর এদিনে মরহুম এটিএম ওয়ালী আশরাফ স্মৃতি সংসদের উদ্যোগে কবর জিয়ারত, ফাতিহা পাঠ ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়।  
৮ সেপ্টেম্বর ১৯৩৭ ইং এ জন্মে ১৯ নভেম্বর ১৯৯৪ খ্রিষ্টাব্দে পরপার, ৫৭ বছরের সংক্ষিপ্ত জীবন। সাধারণ অনাড়ম্বর জীবনের প্রতিচ্ছবি! "ওয়ালী আশরাফের মত এমন গুণী নেতা আর আসবে না" সাধারণ মানুষের এই আফসোসই যেন উনার সফল জীবনের ইঙ্গিত। 
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলাধীন বাঞ্ছারামপুর উপজেলার ছয়ফুল্লাকান্দি ইউনিয়নের ডোমরাকান্দি গ্রামে জন্ম। পিতা: আলহাজ্ব মোঃ আতিক উল্লাহ, রেলওয়ে বিভাগে চাকরি ও মুসলিম লীগের রাজনীতি পছন্দ করতেন এবং মাতা আলহাজ্ব নূর জাহান বেগম, একজন গৃহিণী ছিলেন। 
ভাই-বোনের মধ্যে ২য় কিশোর আশরাফ লেখাপড়ার জন্য তার মামা ডা. সামসুল ইসলামের কাছে চলে আসেন। মামার বাড়ি ও কর্মস্থল ছিল দাউদকান্দি থানার গৌরীপুর। গৌরীপুর সুবল আফতাব হাই স্কুল থেকে ১৯৫৪ সালে কৃতিত্বের সাথে মেট্রিকুলেশন পাশ করেন। ডাক্তার শামসুল ইসলাম গৌরীপুর থেকে বিভিন্ন সময়ে নির্বাচন করেছিলেন এবং সেই রাজনীতির ছোঁয়া আমাদের আশরাফের গায়েও লেগেছে। তিনি মামার দেশ ও রাজনীতির ভাবনায় অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। তারপর চলে যান আরেক মামার কাছে যিনি থাকতেন বরিশাল। বরিশাল বিএম কলেজ থেকে ১৯৫৬ সালে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে উচ্চ  শিক্ষার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ভর্তির সুযোগ পেয়ে যান। সেখান থেকে ১৯৬১ সালে বি.এ/অনার্স ও ১৯৬২ সালে এম.এ/মাস্টার্স সম্পন্ন করেছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালীন রাজনীতিতে মনোযোগ দেন। তিনি সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের আবাসিক ছাত্র ও ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতিও ছিলেন। একই সালে গণতান্ত্রিক ছাত্র আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রাখায় গ্রেফতার হন। 
এরপর সাংবাদিকতা পেশায় যোগ দেন। বাংলাদেশে বিভিন্ন সংবাদপত্রে কাজ করে অভিজ্ঞতা অর্জনের পর বিশ্ব সেরা আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম বৃটিশ ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন, বিবিসিতে কাজের সুযোগ পেয়ে যান আমাদের অজপাড়া গাঁ ডোমরাকান্দির আশরাফ! চলে যান লন্ডনে। বিবিসিতে কঠিন দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। পাশাপাশি তিনি চিন্তা করলেন লন্ডনে একটি বাংলা পত্রিকা প্রকাশ করার। ১৯৬৯ সালে তার সম্পাদনায় শুরু হলো সাপ্তাহিক জনমত প্রকাশ।  ইতিহাস বলে তার প্রতিষ্ঠিত সাপ্তাহিক জনমত পত্রিকাই হল বিদেশের মাটিতে মুদ্রিত ও প্রকাশিত প্রথম বাংলা পত্রিকা। সময়ের তুলনায় চিন্তায় অগ্রসর ছিলেন আমাদের প্রিয় আশরাফ! 
এমন সময় বেজে উঠল যুদ্ধের দামামা। ১৯৭১ সালের মার্চ মাস। শুরু হয়ে গেল আমাদের মুক্তিযুদ্ধ! পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন, স্বাধীনতার সংগ্রাম। তিনি 'সাপ্তাহিক জনমত পত্রিকা'র মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে, আমাদের স্বাধীনতার পক্ষে, সংবাদ প্রচার ও লিখতে থাকলেন। মুক্তিযুদ্ধকালীন লন্ডনভিত্তিক বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সদস্য ছিলেন এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে প্যারিস সহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সমাবেশে বক্তব্য প্রদান করেন। 
আশরাফ ভাই ছিলেন দিল দরিয়া লোক, তিনি লন্ডনে থাকাকালে অনেক বাঙালি তার বাসায় থেকেছে। ডিসেম্বরে দেশ স্বাধীন হল। পরবর্তীতে বাংলাদেশ সরকার তাকে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে বীর মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দেয়। স্বাধীনতার পর লন্ডন থেকে দেশে ফিরে আসেন। ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ থেকেও সাপ্তাহিক জনমত প্রকাশ করেছিলেন। ১৯৭৪ সালে বাকশাল কায়েমের পর সরকার সব পত্রিকা বন্ধ করে দেয়। পেশার পাশাপাশি রাজনীতিতে মনোযোগ দেন।  ১৯৭৬ সালে ডেমোক্রেটিক লীগে যোগ দেন। বীর মুক্তিযোদ্ধা অলি আহাদের (ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানার বাবা) সভাপতিত্বে  এটিএম ওয়ালী আশরাফ ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি হন।
বাকশাল কায়েমের কারণে তাদের রাজনীতি করার সুযোগ কমে যায়। ডেমোক্রেটিক লীগ তার রাজনৈতিক আবেদন হারায়, নেতারা বিচ্ছিন্ন হয়ে বিভিন্ন দলে যোগদান করে। তিনি ধীরে ধীরে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের জাতীয়তাবাদী দর্শনে বিশ্বাসী হয়ে বিএনপিতে যোগ দেন।
কালক্রমে হয়ে উঠেছিলেন অত্যন্ত জনপ্রিয় জনদরদী রাজনীতিবিদ ও সমাজসেবক। মরহুম আশরাফ ছিলেন প্রকৃত অর্থে মা মাটি ও মানুষের নেতা। ব্রাহ্মণাড়িয়া-৬ বাঞ্ছারামপুর থেকে পরপর ২ বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। প্রথমবার ১৯৮৮ যে স্বতন্ত্র ও দ্বিতীয়বার বিএনপি থেকে ১৯৯১ তে ধানের শীষ প্রতীকে। 
তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রথম ১৯৮৬ সালে মোমবাতি মার্কায় স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে জাতীয় পার্টির মোঃ সহিদুর রহমানের লাঙ্গল প্রতীকের কাছে হেরে যান। ২৮,০০০ ভোট পেয়ে এমপি নির্বাচিত হয় কদমতলী গ্রামের মোঃ সহিদুর রহমান। এটিএম ওয়ালী আশরাফ পেয়েছিলেন ২০,০০০ ভোট। কথিত আছে, তৎকালীন ক্ষমতাসীন স্বৈরশাসক লে. জেনারেল হুসাইন মুহাম্মদ এরশাদ প্রশাসনের প্রত্যক্ষ মদদে সহিদ ভোট কারচুপির মাধ্যমে বিজয় অর্জন করেছিলেন। 
দ্বিতীয়বার ১৯৮৮ সালে চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মোমবাতি মার্কায় স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে জাতীয় পার্টির মোঃ শহীদুর রহমান লাঙ্গল প্রতীককে পরাজিত করে প্রথমবার এমপি নির্বাচিত হন। 
তারপর ১৯৯১ ইং সালে ৫ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল, বিএনপি' থেকে ধানের শীষ প্রতীকে ৩৫,১৭২ ভোট পেয়ে দ্বিতীয়বার এমপি নির্বাচিত হন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ থেকে নৌকা প্রতীক নিয়ে ক্যাপ্টেন (অব:) এবি তাজুল ইসলাম, প্রাপ্ত ভোট ৩০,৬১৩ । আশরাফ ভাই তথ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতিও হয়েছিলেন। 
১৯৬৭ সালে ইসলামী শরীয়া মোতাবেক পারিবারিকভাবে বিয়ে করেন রেবেকা সুলতানাকে, পরবর্তীতে তিনি রেবেকা ওয়ালী হিসেবে পরিচিত হন। ভাবির ডাক নাম ছিল রোজি। ঢাকার বাসিন্দা পুলিশ কর্মকর্তা বাবা আর গৃহিনী মায়ের সুসন্তান ছিল রোজি ভাবি। ভাবী অত্যন্ত সদালাপী ও অতিথি পরায়ণ ছিলেন। সুখী দাম্পত্য জীবনের উদাহরণ এই দম্পতি। ১৯৯০ সালে মক্কা-মদিনায় তিনি সস্ত্রীক পবিত্র হজব্রত পালন করেন। এই দম্পতির ৩ সন্তান রয়েছে যথাক্রমে রাইকা ওয়ালী খান (ইউএনডিপিতে কর্মরত, ঢাকায় বসবাস), মৌলি সামিরা ওয়ালী রহমান (লন্ডনে বসবাস)  ও রুদ্র তৌহিদ ওয়ালী (ব্যবসা ও ঢাকায় বসবাস)। রাজনৈতিক মাঠে তাদের কাউকে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে দেখা না গেলেও বাঞ্ছারামপুরের বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে মাঝে মধ্যে উপস্থিত থাকেন, কয়েকটি অনুষ্ঠানে তাদের সাথে দেখা হয়েছে। 
বাঞ্ছারামপুরের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সমাজ উন্নয়নে তার অবদান রয়েছে। কয়েকটি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও হাইস্কুল প্রতিষ্ঠার পেছনে উৎসাহ প্রদান করেন। বাঞ্ছারামপুর কলেজটি অর্থের অভাবে প্রায় বন্ধ হওয়ার উপক্রম থেকে রক্ষা করতে ১৯৭৮ সালে তিনি নিজে নগদ ২০,০০০/- টাকা অনুদান প্রদান করেন যা সর্বাগ্রে কলেজের অনার বোর্ডে আজও স্বর্ণাক্ষরে জলজল করছে। আজকের অর্থমূল্যে হয়ত ২০ লাখ টাকার মত! নিজে সাংবাদিক হওয়ায় সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের প্রতি যত্নশীল ছিলেন। সাংবাদিকদের পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে মনে করে বাঞ্ছারামপুর প্রেসক্লাব স্থাপনের জন্য উৎসাহ প্রদান করেন। 
নব্বইয়ের দশকে সড়ক পথ নির্মাণ ও বাস্তবায়নে তিনি বাঞ্ছারামপুরের ম্যাপে প্লাস (+) চিহ্ন এঁকে বলেছিলেন, আমাদের প্রিয় বাঞ্ছারামপুর ৪ দিক দিয়ে রাজধানী ঢাকা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা সদর ও বন্দর নগরী চট্টগ্রামের সাথে সংযুক্ত হবে। ১. উত্তরে, বাঞ্ছারামপুর সদর-দশদোনা-সোনারামপুর-মেঘনার তীরে মরিচা ঘাট থেকে নরসিংদী ও ঢাকা সিলেট মহাসড়ক ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা সদরে সংযোগ। ২. দক্ষিণে, বাঞ্ছারামপুর সদর-উজানচর-রাধানগর--কালিকাপুর থেকে হোমনা হয়ে গৌরিপুর দিয়ে ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়কে সংযোগ। ৩. পূর্বে, বাঞ্ছারামপুর সদর-আসাদনগর-রূপসদী-ফরদাবাদ থেকে রামচন্দ্রপুর দিয়ে কুমিল্লা হয়ে বন্দর নগরী চট্টগ্রামে সংযোগ। অপর একটি বাইপাস আসাদনগর থেকে ফতেপুর হয়ে ছয়ফুল্লাকান্দি শাহ রাহাত আলী দরগা হয়ে দড়িকান্দি মাঝিআরা বাজার দিয়ে নবীনগর উপজেলা হয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা সদরে সংযোগ। ৪. পশ্চিমে, বাঞ্ছারামপুর সদর-আইয়ুবপুর-কড়ইকান্দি- ফেরিযোগে বিশনন্দি হয়ে  আড়াইহাজার-গাউসিয়া দিয়ে ঢাকা সিলেট মহাসড়কে সংযোগ। 
কালের আবর্তে ৩০ বছর পর আজ ঢাকা-আগরতলা মহাসড়ক হচ্ছে আমাদের আশরাফ ভাইয়ের আঁকা প্লাস (+) চিহ্নের উপর দিয়ে। ঢাকা-গাউসিয়া-আড়াইহাজার-বিশনন্দি কড়ইকান্দি ফেরিঘাট-আইয়ুবপুর-বাঞ্ছারামপুর সদর-আসাদনগর-ফতেপুর-ছয়ফুল্লাকান্দি শাহ রাহাত আলী দরগা-দড়িকান্দি মাঝিআরা বাজার- নবীনগর উপজেলা দিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা সদর সংযুক্ত হয়ে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলার সাথে সংযোগ। আরো উল্লেখ্য, বিশনন্দি কড়ইকান্দি ফেরিঘাটে ৫ম মেঘনা ব্রীজের অনুমোদন হয়েছে যা আগামী কয়েক বছরের মধ্যে বাস্তবায়ন হতে পারে। 
জননেতা আশরাফ ভাই কৃষক শ্রমিক জনতার সাথে সহজে মিশতে পারতেন। হাত মেলাতেন, আলিঙ্গন করতেন, জমির আইলে বসে খাবার খেয়েছেন, হুক্কা টেনেছেন। প্রখর স্মরণ শক্তি ছিল কাউকে একবার দেখার বহুদিন পর দেখলেও নাম ধরে ডাকতে পারতেন। নির্লোভ ও সৎ জীবন যাপন করতেন। মৃত্যুকালে প্রায় ৭ লক্ষ টাকা ঋণী ছিলেন। তার অনুসারীরা চাঁদা তুলে এই ঋণ শোধ করেছেন মর্মে জানা যায়। দূর্নীতি মুক্ত জীবনের এক দৃষ্টান্তমূলক উদাহরণের নাম এটিএম ওয়ালী আশরাফ, আমাদের প্রিয় নেতা। 
বিদেশে ও ঢাকায় স্যুট প্যান্ট পরলেও বাঞ্ছারামপুরে গেলে বেশিরভাগ সময় সাদা পাজামা পাঞ্জাবি পরতেন। জুতা, হাত ঘড়ি আর ছাতা ছিল সঙ্গী। পাইপ যোগে সিগারেট টানার ছবিটা আজো দৃষ্টি নন্দন! চেহারার সাথে পাঞ্জাবি স্টাইলের গোঁফটা যেন যেন অসাধারণ নবাবী স্টাইল! ফ্যাশন ও স্টাইলের অপূর্ব সমন্বয়ে সাধারণ পরিবেশ থেকে রাজকীয় আয়োজনে নিজেকে খুব সহজেই ফুটিয়ে তুলতে পারতেন আমাদের প্রিয় আশরাফ ভাই। 
মাত্র ৫৭ বছর বয়সে ১৯৯৪ ইং সালে এমপি থাকা অবস্থায় বাঞ্ছারামপুরের কৃতি সন্তান এটিএম ওয়ালী আশরাফের অকাল মৃত্যু হয়। ফুসফুসের ক্যান্সার জনিত সমস্যায় ভুগছিলেন। চিকিৎসার জন্য গিয়েছিলেন সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে। (২০২৩ সালের নভেম্বরে আমি ওই হাসপাতাল ভিজিট করেছি।) কিছুদিন পর চিকিৎসকরা আশার আলো না পেয়ে রোজি ভাবিকে ঢাকায় ফিরিয়ে নিতে পরামর্শ দেন। তার পলিটিক্যাল সেক্রেটারি আব্দুস সাত্তার সরকারের ভাষ্য মতে তাকে ঢাকায় ফিরিয়ে আনার প্রয়োজনীয় অর্থ জোগাড় করতে প্রায় তিন দিন সময় লেগেছিল। আসার দিন বিমান ১২ ঘন্টা লেট করেছিল। সন্ধ্যা ৭ টায় পৌঁছার কথা কিন্তু বিমান পৌঁছেছিল পরের দিন ভোর ৭টায়। তাকে বাসায় আনা হলো। দুপুরের পর স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটলে দ্রুত সিএমএইচ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। হাসপাতালের খুব কাছাকাছি গিয়ে শুনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। দিনটি ছিল ১৯ নভেম্বর ১৯৯৪ ইংরেজি। গল্প প্রচলিত আছে যে সিঙ্গাপুরে ভুল চিকিৎসার পেছনে গভীর ষড়যন্ত্র রয়েছে। 
ছয়ফুল্লাকান্দি ইউনিয়নে মাছিমনগর গ্রামে শাহ রাহাত আলী দরগা মসজিদের পশ্চিম পাশে তাকে কবরস্থ করা হয়। ১৯৯৮ সালে স্ত্রী মরহুমা রেবেকা ওয়ালী (রোজি) ইন্তেকাল করলে তাকেও আশরাফ ভাইয়ের কবরের পাশে সমাহিত করা হয়। পাশাপাশি আছে দুজনের কবর। আল্লাহ তাদেরকে জান্নাতুল ফেরদৌস নসিব করুন। আশরাফ ভাইকে তার অন্তিম ইচ্ছা অনুযায়ী মাজার সংলগ্ন মসজিদের পশ্চিম পাশেই কবর দেওয়া হয়েছে। কবি নজরুলের ইচ্ছার মতই আশরাফ ভাই আনমনে গেয়েছিলেন "মসজিদেরই পাশে আমার কবর দিও ভাই। যেন গোরে থেকেও মোয়াজ্জিনের আজান শুনতে পাই।
সাধারণ ইটা বালিতে গড়া কবরটি বর্তমানে বেহাল দশায় আছে। নাম ফলক মুছে গেছে, সৌন্দর্যের ফুল গাছগুলো মারা গেছে, বাতির অভাবে অন্ধকার থাকে, আবর্জনা পরিষ্কার করা হয় না। এই কবরের পাশে দিয়ে হেঁটে গেলে কেউ বলতে পারবে না যে এটি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা ও বাঞ্ছারামপুরের ২ বারের সাবেক এমপি ও তার স্ত্রীর কবর। এই দায় কি উত্তরাধিকারীদের উপর বর্তায় না? সাবেক জনপ্রিয় এমপির কবরের বেহাল দশা বর্তমান প্রজন্মকে কিছু ইঙ্গিত দেয় কি? রাজনৈতিক পরিচিতি অর্জনে যারা তার মহামূল্যবান ছবি ব্যবহার করে, তাদের কি কোন দায় নেই? ইলেকশনের আগে কবরে আনাগোনা পরে বেমালুম ভুলে যাওয়া কি ঠিক? আমাদের ভুল শোধরানোর উপায় আছে কি? আগামী প্রজন্ম হয়ত এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজবে। 
শাহ রাহাত আলী মাজার শরীফকে ঘিরে আশরাফ ভাইয়ের অনেক স্বপ্ন ছিল। মাজার জিয়ারতে আসা ভক্তদের জন্য লঙ্গরখানা থাকা, এতিমখানা ও মাদ্রাসা বানানো, মাজার শরীফ ও মসজিদের সংস্কার করা ইত্যাদি। এটিএম ওয়ালী আশরাফ স্মৃতি ইয়াতিমখানা ও মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করে তার স্মৃতি বাঁচিয়ে রাখা যায়। তার গ্রামে এটিএম ওয়ালী আশরাফ মেমোরিয়াল টেকনিক্যাল স্কুল/কলেজ প্রতিষ্ঠা করা যায়। ২ বারের সাবেক এমপির নামে বাঞ্ছারামপুরে অন্তত ১টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নাম কী হতে পারত না! যে দেশে গুণীর কদর নেই সে দেশে গুণীর জন্ম হয় না’ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর আফসোসের বাণীটি কী বাঞ্ছারামপুরেরই প্রতিফলিত হতে হল? দূরভাগ্য আমাদের! 
তার কৃতিময় জীবন কর্মকে স্মরণ ও বাঁচিয়ে রাখতে ১৯৯৪ সালে মরহুম এটিএম ওয়ালী আশরাফ স্মৃতি সংসদ গঠিত হয়েছিল। তার ব্যক্তিগত সহকারী বর্তমান উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য ফরদাবাদের আব্দুস সাত্তার সরকারের প্রচেষ্টায় এই সংগঠনটি মরে মরে কোন রকম বেঁচে আছে! তিনি প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। কোন ফান্ড নেই। তার আফসোস অনেকই কমিটিতে পদে আসতে চায় কিন্তু দায়িত্ব পালন করতে উদাসীন। তার প্রত্যাশা রাজনৈতিক উত্তরাধিকার তরুণ প্রজন্ম এই সংগঠনকে গতিশীল করতে আগ্রহী হবে। সাম্প্রতিক ছাত্র জনতার জুলাই বিপ্লবের পর তাদের কবরের সাধারণ কিছু সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। 
পরিশেষে বলতে চাই, রাজনৈতিক পূর্বপুরুষদের প্রতি, পথ প্রদর্শকদের প্রতি, গুরুজনদের প্রতি, আমরা যারা আদর্শিক উত্তরাধিকার, চেতনার উত্তরাধিকার, রক্ত মাংসের উত্তরাধিকার, সুবিধার উত্তরাধিকার, আমাদের দায় স্বীকার করার  সংস্কৃতি চর্চা করা আবশ্যক। পদ-পদবী অবস্থান, বর্ষা বা সুদিন নির্বিশেষে আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করা উচিত নতুবা আমাদের কবরের হয়ত একই দশা হতে পারে! 
এটিএম ওয়ালী আশরাফ অমর হোক, জাতীয়তাবাদ জিন্দাবাদ, স্মৃতি সংসদ জিন্দাবাদ, বাংলাদেশ জিন্দাবাদ। 
নোট: পরিবারের সদস্যদের সাথে ব্যক্তিগত আলাপ, অনুসারীদের বক্তব্য, সরকারি দপ্তর ও ইন্টারনেটে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী লিখেছি। তথ্যের গরমিল বা পরামর্শ থাকলে যোগাযোগ করার অনুরোধ করছি। 
লেখক: অ্যাডভোকেট মীর আব্দুল হালিম
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের সদস্য।

Side banner