শেরপুরের সীমান্তবর্তী ৩ উপজেলাতে শ্রীবরর্দী, ঝিনাইগাতী ও নালিতাবাড়িতে ভারতীয় হাতির পায়ে পিষ্ট হয়ে ৩৪ সীমান্তবর্তী মানুষের মৃত্যুর ক্ষতিপূরণ দাবিতে ঢাকার জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে শেরপুর জেলা উন্নয়ন সংগ্রাম পরিষদের মানববন্ধন কর্মসূচী অনুষ্ঠিত হয়েছে। শনিবার (১১ মে) এ মানববন্ধন কর্মসূচি পালিত হয়।
মানববন্ধনে সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের প্রধান সমন্বয়কারী মহিউদ্দিন আহমেদ। মানববন্ধনের সংহতি জানান বাসদের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক রাজেকুজ্জামান রতন।
বক্তব্য রাখেন সংগঠনের যুগ্ম সমন্বয়কারী অ্যাডভোকেট মনিরুজ্জামান শাশ্বত মনির, হাফিজুল করিম, মো. সুমন আহমেদ, সালাউদ্দিন নেট ভাসানীর স্বপন সাহা, ডাক্তার আমিনুল, নারী নেত্রী মিলি সহ অনেকে।
অনুষ্ঠানের বক্তারা বলেন, হাতি যখন ফসল এবং ঘরবাড়ি নষ্ট করে তখন মানুষ ফিরাতে গিয়ে হাতির পায়ে পৃষ্ঠ হয়ে মৃত্যু হয়। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে বন বিভাগের থেকে সামান্য কিছু অর্থ পেয়ে থাকে। আবার অনেক সময় হাতিকে আঘাত করে মেরে ফেলে। এজন্য বনবিভাগ এবং স্থানীয় থানা পুলিশ জনগণকে মামলা দিয়ে হয়রানি করে। আমরা এ থেকে মুক্তি চাই।
সভাপতির বক্তব্যে মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, শেরপুর জেলার ঝিনাইগাতী, নালিতাবাড়ী ও শ্রীবরর্দী পাহাড়ি এলাকায় নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন ভারত বাংলাদেশ দীর্ঘ পাহাড় ঘেষা সীমান্তবাসী।
নালিতাবাড়ী উপজেলার মধুটিলা ইকোপার্কের বাতকুচি পাহাড়ে প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে অবস্থান করছে ৫০-৬০টি হাতির একটি দল। দিনে জঙ্গলে গা-ঢাকা দিয়ে থাকলেও, রাত নামতেই খাবারের খোঁজে তারা হানা দিচ্ছে ফসলের ক্ষেতে। একই অবস্থা ওই দুই উপজেলাতেও। রাতভর তাণ্ডব চালিয়ে ভোরের আলো ফুটতেই হাতির পাল ঢুকে পড়ে জঙ্গলে। সামনে কাউকে পেলেই আক্রমণ করে।
সর্বশেষ গত ১৮ এপ্রিল বৃহস্পতিবার রাতে নালিতাবাড়ী উপজেলার পোড়াগাঁও ইউনিয়নের বাতকুচি গ্রামে ফসল রক্ষা করতে গিয়ে হাতির পায়ে পিষ্ট হয়ে প্রাণ হারান কৃষক উমর আলী। দুই মাসের ব্যবধানে হাতির আক্রমণে এ নিয়ে দু’জন প্রাণ হারালেন।
স্থানীয়রা জানান, এক সপ্তাহ ধরে এক দল ভারতীয় বুনো হাতি সীমান্তবর্তী বাতকুচি গ্রামের পাহাড়ি ঢালে বোরো ক্ষেতে নেমে খেয়ে ও পা দিয়ে মাড়িয়ে ফসল নষ্ট করছে। বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল রাতেও এক দল হাতি বাতকুচি গ্রামে ধানক্ষেতে আসে। এ সময় উমর আলী সহ গ্রামবাসী তাদের ফসল বাঁচানোর জন্য মশাল জ্বালিয়ে চিৎকার করে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। এক পর্যায়ে হাতির পাল একটু পিছু হটলে নিজ বাড়ির দিকে যেত থাকেন উমর আলী। পথিমধ্যে কয়েকটি হাতি তাঁকে ঘিরে ফেলে পা দিয়ে পিষে ও শুঁড়ে পেঁচিয়ে হত্যা করে।
নালিতাবাড়ী থানার ওসি ও ময়মনসিংহ বিভাগীয় বন কর্মকর্তা নিহত কৃষকের পরিবারকে সরকারিভাবে ৩ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ব্যবস্থা করছেন বলে আমরা জানতে পেরেছি। কিন্তু ভারতের সরকার বা আসাম রাজ্য সরকার এখন পর্যন্ত এ ব্যাপারে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। এমনকি নিহত ও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে সহায়তা প্রদান করেনি। এর আগে ২৯ মার্চ একই উপজেলার নাকুগাঁও এলাকায় ফসল রক্ষা করতে গিয়ে হাতির ধাওয়া খেয়ে জেনারেটরের খোলা জিআই তারে জড়িয়ে উসমান আলী নামে একজন মারা যান। আমরা স্থানীয় জনগণের সাথে কথা বলে জানতে পারি, সন্ধ্যা নামলেই হাতিগুলো সড়কে ও লোকালয়ে চলে আসছে। হাতির পাল ফসলের ক্ষেতে এসে তাণ্ডব চালায়। এ সময় বাড়িঘর, গাছপালা ভাঙচুর করে। হাতির বিচরণ বেড়ে যাওয়ায় পাহাড় বেষ্টিত জনগোষ্ঠীর ছেলেমেয়ে নিয়ে আতঙ্কে আছেন। হাতির ভয়ে আমাদের নির্ঘুম রাত কাটছে। শ্রীবরদী, ঝিনাইগাতী ও নালিতাবাড়ী এলাকার মানুষকে হাতির উপদ্রব থেকে বাঁচাতে ভারত ও বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে স্থায়ী পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। দিনে দিনে হাতির তাণ্ডবে প্রাণহানি ও ফসলের ক্ষতির পরিমাণ বাড়ছে।
বন বিভাগের ও বিভিন্ন গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী তথ্যমতে, ২০১৪ সাল থেকে এক দশকে শুধু গারো পাহাড়ে হাতির আক্রমণে ৩৪ জন প্রাণ হারিয়েছেন। আহত হয়েছেন দুই শতাধিক। একই সময়ে মানুষের হামলাসহ নানা কারণে ৩০টি হাতিও মারা গেছে। বাংলাদেশ ভারত সীমারেখা দীর্ঘ পাহাড় ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা ও শেরপুরে ১১৯ কিলোমিটার সীমান্ত এলাকায় সোলার ফ্যান্সিং স্থাপন, অভয়ারণ্য গড়ে তোলা সহ টেকসই পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য আমরা ভারত সরকার এবং বাংলাদেশ সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
হাতির খাদ্য হিসেবে পাহাড়ের লতাপাতা সেগুলোও দুর্বৃত্তকারীরা আগুন দিয়ে প্রায় ২০/৫০ একর বনভূমি পুড়িয়ে ধ্বংস করে দিয়েছে। চিনামাটি ও গাছ সংগ্রহের জন্য একপ্রকার দুর্বৃত্তকারী বন উজাড় করে দিচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। আমাদের দাবি: ১) নিহত প্রত্যেক পরিবারকে আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী সহযোগিতা ও পুনর্বাসন করতে হবে ২) হাতিদের খাওয়া দাওয়া ও চলাফেরা স্বাভাবিক রাখতে নির্দিষ্ট হাতি অভয়ারণ্য কেন্দ্র স্থাপন করতে হবে। প্রয়োজনে ভারত বাংলাদেশ সরকার যৌথভাবে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পারে ৩) ফসল ক্ষয়ক্ষতির শিকার কৃষকদের সাহায্য সহযোগিতা ও পুনর্বাসন করতে হবে ৪) শেরপুর জেলাকে পর্যটন জেলা হিসেবে ঘোষণা করতে হবে ৫) মানুষ ও হাতির মৃত্যু রোধ নিশ্চিত করতে হবে ৬) বনে আগুন জ্বালিয়ে বনভূমি ধ্বংসকারীদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। অবৈধভাবে বালু, পাথর উত্তোলন এবং গাছপালা নিধন করা বন্ধ করতে হবে।
আপনার মতামত লিখুন :