লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসা সেবার কার্যক্রম চলছে জনবল সংকটে। রবিবার (৮ ডিসেম্বর) আদিতমারী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ঘুরে দেখা গেলো এমন দৃশ্য।
উপজেলার ৮টি ইউনিয়নের মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে ৩১ শয্যা বিশিষ্ট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স নির্মাণ করা হয়। পরবর্তীতে রোগীদের দুর্ভোগ কমাতে ৩১ শয্যা থেকে ৫০ শয্যায় উন্নীত করে সরকার। সেই অনুপাতে জনবল এবং ভবন নির্মান করা হয়। ৩১ শয্যা থেকে ৫০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল হিসেবে উন্নীতকরণ করা হলেও সেবার মান এখনো সন্তোষজনক নয় বলে অভিযোগ ভুক্তভোগীদের।
হাসপাতালের রোগী ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নানান সংকটের মধ্য দিয়ে চলছে এই হাসপাতালের কার্যক্রম। ঘুরে দেখা যায়, হাসপাতালে পুরুষ রোগী থেকে নারী রোগীর সংখ্যা তুলনামূলভাবে বেশি। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে আছেন অনেক মুমূর্ষু রোগী। অপরদিকে জনবল সংকটে স্বাস্থ্যসেবা ব্যাহত হচ্ছে। রোগী অনুপাতে চিকিৎসক স্বল্পতা, ওষুধ সংকট ও খাবার সরবরাহে তেমন সন্তোষজনক সেবা পাচ্ছেন না চিকিৎসা নিতে আসা রোগী ও তাদের স্বজনেরা। এছাড়াও সুইপার সংকট উল্লেখযোগ্য অসুবিধা গুলোর মধ্যে অন্যতম। এ কারণেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ময়লা আবজর্না।
রোগীদের অভিযোগ, রোগ নির্ণয়ের আধুনিক যন্ত্রপাতি তেমন না থাকায় পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য বাইরের ক্লিনিকে তাদেরকে যেতে হচ্ছে। এমতাবস্থায় রোগীদের আর্থিক স্বচ্ছলতা না থাকায় ব্যাহত হচ্ছে চিকিৎসা সেবা।
জানা গেছে, চিকিৎসক সহ নিম্ন জনবল সংকটে চালানো হচ্ছে হাসপাতালের নিয়মিত কার্যক্রম। এখানে উন্নত স্বাস্থ্য সেবা দেয়ার সামান্য কিছু বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি ও ওষুধ থাকলেও সেসবের সুবিধা তেমন পাননা রোগীরা। এই উপজেলায় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রতিদিন চিকিৎসা নিতে আসেন শত শত অসুস্থ মানুষ। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলো যে এই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেই নিত্য দিনের পরিক্ষা নিরীক্ষা করার ল্যাব টেকনিশিয়ান। যদিওবা একজন আছেন তবে তিনি ক্ষণিকের ল্যাব টেকনিশিয়ান হিসেবে কাজ করেন বলে জানা গেছে।
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, আদিতমারী লালমনিরহাটের জনবলের মঞ্জুরীকৃত রাজস্ব পদের সংখ্যা নিম্নরূপ: চিকিৎসক: সৃজনকৃত পদসংখ্যা ২৮, পূরণকৃত পদসংখ্যা ১০, শুন্য পদসংখ্যা ১৮। নার্সিং ও কর্মকর্তা: মঞ্জুরীকৃত পদসংখ্যা ৩১, কর্মরত পদসংখ্যা ৩০ ও শূন্য পদের সংখ্যা ১। তৃতীয় শ্রেণী ও কর্মচারী : মঞ্জুরীকৃত পদের সংখ্যা ৩৭, কর্মরত পদের সংখ্যা ২১ , শূন্য পদের সংখ্যা ১৬।
স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের যন্ত্রের সংখ্যা ও যন্ত্রের ধরণ: ডেন্টাল ইউনিট সংখ্যা: ১টি, যন্ত্র: সচল। এক্স- রে মেশিন সংখ্যা: ১টি, যন্ত্র: সচল। অটোক্লেভ যন্ত্রের সংখ্যা ৪টি, অচল ১টি (অমেরামতযোগ্য)। এনেসথেশিয়া যন্ত্রের সংখ্যা ১টি সচল। ভেন্টিলেটর যন্ত্রের সংখ্যা ১টি সচল। আল্ট্রাসনোগ্রাম যন্ত্রের সংখ্যা ২টি সচল। ইসিজি যন্ত্রের সংখ্যা ২টি, অচল (অমেরামতযোগ্য) ১টি। বায়োকেমিস্ট্রি এনালাইজার যন্ত্রের সংখ্যা ২টি, অচল (অমেরামতযোগ্য) ১টি। মাইক্রোসকোপ যন্ত্রের সংখ্যা ২টি, অচল (অমেরামতযোগ্য) ১টি। জেনারেটর রয়েছে ১টি। এম্বুলেন্স রয়েছে ২টি।
ঠান্ডাজনিত রোগের চিকিৎসা নিতে আসা আদিতমারী উপজেলার হাসান মিঞা (৩০) বলেন, এই হাসপাতালে আমি দুইদিন থেকে রয়েছি। এখানে থাকা অবস্থায় মাঝে মাঝেই দুর্গন্ধ অনুভব করি আর এখানে খাবারের মান তেমন বেশি সুবিধার না। এখানে আমার সঙ্গে মা এসেছেন আর তাকে দিয়ে বাইরের ফার্মেসি থেকে প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী ওষুধ নিয়ে আসি। এখানে কিছু ওষুধ দিয়েছে আর বাকি ওষুধ বাহিরে থেকে আনতে হচ্ছে।
মেয়ের চিকিৎসার জন্য আসা আদিতমারি উপজেলার ভাদাই ইউনিয়নের ময়না বেগম (৪০) বলেন, কয়েকদিন আগে আমার একজন নিকটতম আত্মীয় সিজার করানোর জন্য এখানে ভর্তি হন। ২ দিন থাকার পর চিকিৎসক জানান, এখানে সিজার করা অনেকটা ঝুঁকিপূর্ণ তাই রোগীকে রংপুরে নিতে হবে। পরে আমাদের এলাকার একজন বয়স্ক মহিলার মাধ্যমে বাড়িতেই নরমাল ডেলিভারি হয়।
তিনি বলেন, তাহলে এখানে ডাক্তার থেকে লাভ কি!
উপজেলার সেন্দুরবিন্দা বাসেরতল এলাকার ধনঞ্জয় রায় (৬০) বলেন, আমি জ্বর, সর্দি, মাথা ব্যাথা সহ বেশ কিছু রোগে ভুগছি। তাই দুদিন থেকে এখানে পড়ে আছি। এখানে আল্ট্রাস্নোগ্রাফি থেকে শুরু করে ডিজিটাল এক্সরে মেশিন, ইসিজি, অপারেশন থিয়েটারসহ সব ধরনের ব্যবস্থা থাকলেও টেকনিশিয়ান ও দক্ষ জনবলের অভাবে এগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তাই সাধারণ কিছু চেকআপও বাহিরে থেকে করে নিয়ে আসতে হচ্ছে। এছাড়া জরুরী বিভাগ, অভ্যন্তরীণ চিকিৎসা প্রদান, আউটডোর, অ্যাম্বুলেন্স সেবায় নেই পর্যাপ্ত লোকবল। এক প্রকার নাজুক অবস্থা এ হাসপাতালের।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কয়েক কর্মচারী বলেন, এ মেডিকেলে খাবারের মান তেমন ভালো না। সেই সাথে প্রয়োজনীয় ওষুধও তেমন ভাবে মেলে না তাই বাইরে থেকে ওষুধ নিয়ে আসতে হয়। এখানে ভর্তি হওয়া রোগী রাতে যদি আরো বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ে তাহলে তাৎক্ষণিকভাবে দেখার মত ডাক্তার মেলেনা।
মেডিকেলে নিয়ে আসা একজন অসুস্থ্য রোগীর অভিভাবক বলেন, দুইদিন হলো রোগী ভর্তি করিয়েছি, আমার রোগীর কাছে নার্স আসলেও ডক্টর আসে নাই। এখানে কে ডক্টর আর কে নার্স আমি নিজেও বুঝতেছি না।
আদিতমারীর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. মো. সানাউল হাসান বলেন, চিকিৎসক সহ নিম্ন জনবল সংকটে চলছে হাসপাতালের নিয়মিত কার্যক্রম। এই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রতিদিন চিকিৎসা নিতে আসেন শত শত মানুষ। রোগী অনুপাতে চিকিৎসক স্বল্পতা ও ওষুধ সংকট রয়েছে এখানে। সেই সাথে পরিক্ষা নিরীক্ষা করার জন্য ল্যাব টেকনিশিয়ানের অভাব। বর্তমানে এখানকার খাবারের মান যথেষ্ট ভালো করার চেষ্টা করে যাচ্ছি। এই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের বর্তমানে অন্যতম সমস্যা হলো সুইপার সংকট। যার কারণে ময়লা আবর্জনা পরিষ্কারের একটু সমস্যা হচ্ছে। এই সমস্যাগুলো সমাধান হলে, স্বাস্থ্য সেবার মান আরো ভালো হবে এমনটাই আশা প্রকাশ করেন তিনি।
ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আদিতমারী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জুনিয়র কনসালটেন্ট ডা. মোঃ আজমল হক বলেন, বর্তমানে এস্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসা সেবা চিকিৎসক ও জনবল সংকটের মধ্য দিয়েই পরিচালিত হচ্ছে। ভালো সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ ও চিকিৎসকেরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছেন। জনবলের চাহিদা সহ আরো বেশ কিছু সমস্যা সমাধানের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। আশা করি সাময়িক সমস্যাগুলো খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে শেষ হবে এবং সুচিকিৎসা নিশ্চিত হবে।
আপনার মতামত লিখুন :