ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুর উপজেলার ৪টি ভেজাল গুড়ের কারখানায় তৈরী ‘বিষাক্ত গুড়’ চাহিদা মেটাচ্ছে বাঞ্ছারামপুরসহ হোমনা, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, কুমিল্লাসহ পূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন উপজেলা। গুড়ের নামে বিষ উৎপাদন হচ্ছে অনেকটা প্রকাশ্যে। প্রতিদিন কারখানাগুলো থেকে লাখ লাখ টাকার ভেজাল গুড় তৈরির পর তা সারাদেশে বিক্রির জন্য পাঠানোর অভিযোগ পাওয়া গেছে।
সারা দেশে আখের গুড়ের চাহিদা বাড়ায় বাঞ্ছারামপুর উপজেলার উজানচর ইউনিয়নের উজানচর বাজারে ভেজাল গুড়ের কারখানা গুলোতে গুড় উৎপাদনের নামে বিষ তৈরি হচ্ছে। অধিক লাভের আশায় একটি সিন্ডিকেট চক্র বহুদিন ধরে এই গুড় তৈরী করে আসছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিষয়টি প্রকাশ্যে তৈরী করলেও সাম্প্রতিক সময়ে উজানচরে ভ্রাম্যমান আদালতের কোন অভিযান বা প্রশাসনিক কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। ফলে, প্রতিনিয়ত ভেজাল এবং নোংরা পরিবেশে গুড় তৈরী করে বাজারজাত করছে গুড় উৎপাদনকারীরা। এতে চরম স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পরছে সাধারণ মানুষ।
সম্প্রতি সরেজমিনে উজানচরে ভেজাল গুড় কারখানায় গেলে, সাংবাদিক দেখে কারখানার মালিকরা তাদের কর্মচারীদের রেখে দরজা বন্ধ করে চলে যেতে দেখা যায়। গুড় সিন্ডিকেটদের প্রধান ড্রেজার বাবুল নামে এক গুড় ব্যবসায়ী বাঞ্ছারামপুর প্রেসক্লাবের সভাপতি মোল্লা নাসির ও সহ সভাপতি ফয়সল আহমেদ খান গুড় তৈরির কারখানা পরিদর্শন করতে চাইলে তিনি বাঁধা প্রদান করেন।
সংবাদকর্মীরা মঙ্গলবার উপজেলার উজানচর সড়কে অপেক্ষমান ২টি ট্রাক দেখতে পেয়ে এগিয়ে যায়। ট্রাক ২টিতে গুড়ে ব্যবহার করার জন্য অসংখ্য টিনের কার্টুনে উত্তরবঙ্গের সোনামসজিদ থেকে আসা ভারতীয় ক্ষতিকর ক্যামিকেল ও গুড় তৈরির মালামাল দেখতে পেয়ে প্রশাসনকে তাৎক্ষণিক অবহিত করেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শীত মৌসুমে গুড়ের চাহিদা থাকে বেশী। এ সময় ভেজাল গুড় তৈরীতে মহোৎসবে মেতে উঠে উৎপাদনকারীরা।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, উপজেলা প্রশসানকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বাঞ্ছারামপুর থানার সন্নিকটে উজানচর ইউনিয়নের উজানচর বাজারে গুড় উৎপাদনকারী অন্তত ৪টি কারখানা রয়েছে। এসব কারখানায় নোংরা পরিবেশে ভেজাল গুড় তৈরি করে বাজারে সরবরাহ করে আসছে উৎপাদনকারীরা।
ভেজাল গুড় তৈরি করছে এমন প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, গুড় উৎপাদনকারীরা কয়েকটি কারখানায় বাজার থেকে কিনে আনা নিম্নমানের গুড়গুলো ময়লাযুক্ত মেঝেতে নোংরা স্যান্ডেল পায়ে শ্রমিকরা গুড়ো করেন। পাশেই প্রকাশ্যে রাখা হয় চিনির বস্তা। দিনভর ক্ষতিকর বিষাক্ত হাইড্রোজ আর কেমিকেল মিশিয়ে ভেজাল গুড় তৈরি করা হচ্ছে। আর এসব করছে স্থানীয় খোকন, মিজান, ড্রেজার বাবুল সহ অজ্ঞাত আরো ১ ব্যক্তি সহ ৪ জন অতি প্রভাবশালী ব্যক্তির সিন্ডিকেট।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক ব্যক্তি এই প্রতিনিধিকে জানান, এলাকার অন্তত ১০ জনের একটি সিন্ডিকেট অসাধু ব্যবসায়ী কারখানা খুলে হাজার হাজার মন ভেজাল গুড় তৈরি করছেন। তারা বাজার থেকে কমদামে নিম্নমানের ঝোলা ও নরম গুড় কিনে, গলিয়ে তাতে চিনি, রং, হাইড্রোজ, সোডা, ফিটকারি, পাথরচুন ও বিশেষ গাছের ছাল গুড়া দিয়ে গুড় তৈরি করছেন। সেই গুড় স্থানীয় হাট-বাজারসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় ট্রাক ভরে পাঠাচ্ছেন। কিন্তু প্রশাসন কোন ব্যবস্থা নিচ্ছেনা।
বাঞ্ছারামপুর মাওলাগঞ্জ বাজার (বড়বাজার) হাটে গুড় বিক্রি করতে আসা ইমান আলী জানান, মজুরি, জ্বালানি খরচ বাড়ায় ভেজালের প্রবণতাও বেড়েছে। ভেজাল গুড় বিক্রিতে লাভ ডাবল।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের ক্যান্সার ইউনিটের সহকারী অধ্যাপক ডা. নাইমুর রহমান জানান, গুড়ে চিনি, রং, হাইড্রোজ, সোডা, ফিটকারির মত ভেজাল মিশ্রণের কারণে খাদ্যনালীতে ক্যান্সার, কিডনী ড্যামেজ, লিভারে ক্ষতি হওয়ার সম্ভানা থাকে।
বাঞ্ছারামপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক কাজী রিয়াজুল ইসলাম ভোক্তা হিসেবে বলেন, আমরা কেনার সময় ভেজাল গুড় চিনতে পারলেও কোন কিছু করার থাকেনা। কারণ চিনি মিশ্রিত ব্যতীত স্বচ্ছ ভালো গুড় পাওয়া অত্যন্ত দুস্কর।
তিনি বলেন, ভেজাল প্রতিরোধে প্রশাসনের কঠোর ভূমিকা প্রয়োজন। অন্যথায় গুড় ভেজাল প্রমাণের মাধ্যমে দোষী ব্যক্তিকে সনাক্তে করে আইনের আওতায় নিয়ে না আসা পর্যন্ত ভেজাল দেওয়া বন্ধ হবে না। ভেজাল বন্ধে প্রশাসনের ভূমিকা ছাড়া কোন পথ নেই।
বাঞ্ছারামপুর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. নজরুল ইসলাম বলেন, আমি বছরখানেক আগে একবার অভিযান চালিয়ে ভেজাল গুড় তৈরির কারখানা দেখে ও প্রমাণ পেয়ে ২ লক্ষ টাকা জরিমানা করি। এরা একটা 'শক্তিশালী সিন্ডিকেট' বলে খবর পেয়েছি। যেহেতু, আবারো ভেজাল গুড় তৈরি করার অভিযোগ আসছে, প্রশাসন আবারো ভেজাল গুড় তৈরির বিরুদ্ধে কঠোরভাবে পদক্ষেপ নেবে।
এ বিষয়ে বাঞ্ছারামপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মুহাম্মদ আবুল মনসুর বলেন, যেকোন খাদ্যে ভেজাল মেশানো অন্যায়। উজানচরের গুড়ে ভেজাল মেশানোর অভিযোগ যেহেতু জেনেছি, বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক পরিসরে যেকোনো সময় ব্যবস্থা নেয়া হবে।
আপনার মতামত লিখুন :