রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলায় সমাজসেবা অধিদপ্তর কর্তৃক প্রতিবন্ধী, বয়স্ক, বিধবাসহ অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জন্য বরাদ্দকৃত ভাতার টাকা অত্র উপজেলার, সাবেক কর্মকর্তা (বর্তমানে সমাজসেবা রংপুর শহর শাখায় কর্মরত) আরিফুর রহমানের ব্যবহৃত তিনটি মোবাইল (০১৭৭২২৯৪১৪০, ০১৭১৬০১২১০৩, ০১৩২৪২৩০৬৯৫) নম্বারে যাওয়ার সত্যতা মিলেছে। এর আগে ওই কর্মকর্তার নেতৃত্বে "নগদ অ্যাকাউন্ট খোলার সময়" এজেন্টদের যোগসাজশে, প্রকৃত ভাতা ভোগীদের নম্বরের স্থলে বিশেষ একটি সিন্ডিকেটের নম্বার এন্ট্রি করে অসংখ্য ভাতাভোগীদের টাকা ট্রান্সফার করে নেয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। সে সময় এ নিয়ে প্রতিদিন উপজেলা সমাজসেবা অফিসে ভিড় করতেন ভুক্তভোগী ও তার স্বজনরা। তবে সমাজসেবা অফিস কর্তৃক নিয়োজিত স্থানীয় আওয়ামী সন্ত্রাসীদের ভয়ে কেউ-ই প্রতিবাদ করার সাহস পায়নি বলে দাবি অন্তত ৩০ জন সুবিধাভোগীর।
২০২৪-২৫ অর্থ বছরে বরাদ্দকৃত প্রথম কিস্তির টাকা বিতরণ হয় গত ০৫/০৬ নভেম্বর ২০২৪ইং তারিখে। দীর্ঘ তিনমাস অপেক্ষার পরে ভাতার টাকা না পাওয়া কয়েকশত সুবিধাভোগী প্রতিবন্ধী, বিধবা, বয়স্করা উপজেলা সমাজসেবা অফিসে গিয়ে জানতে পারেন সমাজসেবার ওয়েবসাইট হ্যাক করে তাদের নগদ অ্যাকাউন্টে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির টাকা হ্যাকাররা নিয়েছে। সমাজসেবা কর্মকর্তা কর্মচারীদের এমন বক্তব্যে হতাশ হয়ে পরেন ভাতার টাকা তুলতে আসা অসহায় হতদরিদ্র সুবিধা বঞ্চিতরা।
উপজেলার লালদীঘি ফতেপুর কলাবাগান বারই পাড়া গ্রামের মোঃ রিপু মিয়া (দৃষ্টি প্রতিবন্ধী) বলেন, আমি এর আগে দুইবার ভাতা পাইছি কিন্তু এবার পাইনি! সমাজসেবা অফিসারের কাছে গেছিলাম, তিনি আমাকে ভোটার আইডির ফটোকপি জমা দিতে বলেছে। আমি যথারীতি জমা দিছি। অফিসারের কাছে জানতে চাইছিলাম আমার ভাতার টাকা আসেনি কেন? আমাকে বললেন আপনার টাকা হ্যাকাররা হ্যাক করেছে, আপনি নতুন করে নগদ আইডির পিন কোড পরিবর্তন করেন। তখন আমি বললাম, আমার নগদ নম্বর (০১৯১৯২৪৩৪৭৪) চেক করেছি কোন টাকা আসেনি, এসএমএসও আসেনি। একাউন্টে টাকা না আসলে হ্যাকাররা হ্যাক করে কিভাবে! এরপরেও তিনি আমাকে বললেন আপনার টাকা হ্যাকাররা নিয়ে গেছে, আপনি পিন নম্বর চেঞ্জ করেন!
একই এলাকার প্রতিবন্ধী মো. বাচ্চু মিয়া বলেন, আমার ভাতার টাকা আসেনি, আমি পীরগঞ্জ সমাজসেবা অফিসে গিয়েছিলাম, ইউনিয়ন সমাজকর্মী আলমগীর আমাকে বলছে, ধৈর্য ধরেন আপনার ভাতার টাকা যাবে। দুইদিন পরে আবার সমাজসেবা অফিসে গেলে আলমগীর বলেন, আমাদের নাম্বার নাকি হ্যাক হইসে, হ্যাকার নাম্বার পালটাই দিয়া টাকা নিয়া নিছে। নাম্বার পরিবর্তনের বিষয় জানতে চাইলে বাচ্চু মিয়া বলেন, আমি নাম্বার পরিবর্তনের কোন আবেদন করিনি। পীরগঞ্জ সর্দারপাড়া এলাকার ফেলানি বেগম জানান, দিন আনি দিন খাই। ভাতার টাকাটা পাইলে খরছ করনো হয়। এবার সবায় ভাতা পাইছে। হামার টাকা ঢোকে নাই। সবাই যখন হামার ওটি পাইলো তখন স্যারের কাছে আইলে স্যার কইলো তোমার ট্যাকা ঢুকছে। আমি কইলাম স্যার টাকা ঢুকলে মেসেজ কই পাইনো। পরে স্যার বৃহস্পতিবার ডাকিল। বৃহস্পতিবার আইলে স্যার কইলো নতুন সিম কিনো। তোমার টেকা হ্যাকার নিয়ে গেইছে।
তবে ৩নং বড়দরগাহ ও ১০নং শানের হাট ইউনিয়ন সমাজকর্মী আলমগীর হোসেন বলেন, অফিসিয়াল সফটওয়্যার থেকে ভাতাভোগীদের নম্বর পরিবর্তন করে অন্য নম্বরে টাকা ট্রান্সফার করা হয়েছে। কে নম্বর পরিবর্তন করেছে তা তিনি জানেন না বলে জানান।
সমাজসেবা অধিদপ্তর সুত্রে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী অনুসন্ধানে দেখা যায় পীরগঞ্জ উপজেলা অফিসের মাধ্যমে প্রতিবন্ধী, বয়স্ক, বিধবা ভাতাসহ উপজেলার অনগ্রসর ভাতাভোগীদের প্রায় ৪০০ জনের নম্বর পরিবর্তন করেছেন উপজেলা সমাজসেবা কর্তৃপক্ষ, পাশাপাশি ভাতাভোগীদের টাকাও ট্রান্সফার করে নিয়েছেন তারা। নম্বর পরিবর্তনের বিষয়টি প্রথমে এড়িয়ে গেলেও পরে জালিয়াতির কথা স্বীকার করেন বর্তমান পীরগঞ্জ উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা আব্দুর রাজ্জাক।
তিনি বলেন নম্বর পরিবর্তন ইদানীং হয়েছে! তবে তদন্ত করে দেখতে হবে এই অনিয়ম কার আমলে হয়েছে। ইদানীং (৫ আগস্ট পরবর্তী) আমি ছাড়াও আরও দুইজন এই চেয়ারে ছিল। গত ৩০/০৬/২০১৯ ইং হইতে ১১/০৮/২০২৪ইং দায়িত্ব পালন করেন বর্তমান রংপুর শহর শাখায় কর্মরত আরিফুর রহমান, ১১/০৮/২০২৪ ইং ১১/০৯/২০২৪ইং পর্যন্ত একমাস অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করেন মিঠাপুকুর উপজেলার বর্তমান কর্মকর্তা আব্দুল হামিদ। ১১/০৯/২০২৪ইং থেকে কর্মরত আছেন আব্দুর রাজ্জাক। এর আগে তিনি লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্বপালন করেন। সেখানে দায়িত্ব পালনকালে বিভিন্ন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির ভাতাভোগীদের নাম দিয়ে ভুয়া মাস্টাররোল সৃষ্টির মাধ্যমে কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগ গণমাধ্যমে প্রকাশ হলে, কতৃপক্ষ তাকে বদলী করে কালীগঞ্জ থেকে পীরগঞ্জে পাঠান। নাম পরিচয় গোপন রাখার শর্তে কালীগঞ্জ উপজেলা সমাজসেবায় কর্মরত একাধিকজন বলেন, আব্দুর রাজ্জাক ছিল সাবেক সমাজ কল্যাণ মন্ত্রী নুরুজ্জামানের মদদপুষ্ট বিশেষ সিন্ডিকেটের সদস্য। এই সিন্ডিকেটের সদস্যরা কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছে। দুদক অথবা গোয়েন্দা সংস্থাগুলো তদন্ত করলে সবাইকে খুঁজে পাওয়া যাবে। আব্দুর রাজ্জাক কালীগঞ্জে কর্মরত থাকাকালীন নানামুখী অনিয়মের সাথে জড়িত ছিল। ইতোপূর্বে জালিয়াতি করার কারণে বিক্ষুব্ধ ভাতাভোগীরা তার মাথা ফাঁটিয়ে ছিল বলে জানা গেছে।
দুর্নীতির চিহ্ন মুছে ফেলতে উপজেলা সমাজকল্যাণ পরিষদের বণ্টনকৃত মাস্টাররোল সহ যাবতীয় নথিপত্র হারিয়ে গেছে উল্লেখ করে, গত ৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪ইং অফিস সহকারী পারভীন বেগমকে বাদী করে থানায় সাধারণ ডায়েরি করান।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে রংপুর শহর শাখা সমাজসেবা কার্যালয়ের কর্মকর্তা আরিফুর রহমান বলেন, আমি পীরগঞ্জে থাকা কালীন অনেক নম্বর পরিবর্তন হয়েছে, তবে আমি কোন অনিয়ম করিনি। আর আমার ব্যবহৃত তিনটি নম্বর (০১৭৭২২৯৪১৪০, ০১৭১৬০১২১০৩, ০১৩২৪২৩০৬৯৫) কে বা কারা প্রতিবন্ধী ভাতা উপকারভোগীদের একাউন্টে রিপ্লেস করেছে তা আমি জানি না। আমাকে ফাঁসানোর জন্য এটা করা হতে পারে। উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের তদন্তের মাধ্যমে সত্যতা বেরিয়ে আসবে। এই কাজ কে করেছে তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে এবং এ ব্যাপারে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
প্রতিবন্ধী ভাতা প্রধান সফটওয়্যারে উপকারভোগীদের নগদ একাউন্ট নম্বরের জায়গায় সমাজসেবা কর্মকর্তা আরিফুর রহমানের নগদ নম্বর রিপ্লেস করে অর্থ হাতিয়ে নেয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে রংপুর জেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা আব্দুল মতিন বলেন, বিষয়টি আমি অবগত হয়েছি, আমি ইতোমধ্যেই অধিদপ্তরে বিষয়টি জানিয়েছি এ মাসের মধ্যেই একটি এক্সপার্ট টিম আসবে। তদন্ত পরবর্তীতে বেরিয়ে আসবে আসলে এই ঘটনা কে ঘটিয়েছে।
ভাতা উপকার ভোগীদের নম্বর পরিবর্তনের এক্সেস কার কাছে থাকে এমন প্রশ্নের জবাবে আব্দুল মতিন বলেন, এই এক্সেস শুধুমাত্র উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তার কাছেই থাকে। আমার জানামতে আর অন্য কোথাও থাকে না।
এমন ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা নেয়া হবে জানতে চাইলে বিষয়টি তিনি এড়িয়ে যান।
আপনার মতামত লিখুন :